(পরিচালক বাক্ )
Wednesday, September 30, 2015
সমীরণ মজুমদারের সঙ্গে আমার
আলাপ ২০০৪ সালে, কবিতার সূত্রেই। ‘অমৃতলোক’-এ কবিতা লিখতে চায়না, এমন তরুণ কবি সম্ভবত বিরল ছিলেন
আমাদের দেশে সেই সময়। আমিও পাঠিয়েছিলাম। সমীরণদার কবিতাবিশ্বাস অন্যরকম ছিল,
কিন্তু সেই কবিতাটি প্রকাশিত হয়েছিল। উনি সোৎসাহে ফোন করেছিলেন। একটা অসম বন্ধুত্ব
তৈরি হয়েছিল। সেই বন্ধুত্ব আমাকে যতটা দিয়েছে, আমি ওঁকে সেই সাপেক্ষে কিছুই দিতে
পারিনি। জলের সমোচ্চশীলতা আর কী!
গদ্য লেখার কোনো ইচ্ছে বা মানসিকতা আমার সেই অর্থে ছিলনা।
সমীরণদা আমাকে লেখালেন। কবি ভাস্কর চক্রবর্তী যেদিন মারা গেলেন, ভাস্কর আমার
প্রাণের কবি ছিলেন, ঠিক সেদিনই আমি ভাস্করের উপরে একটি প্রবন্ধ লিখলাম, এবং সেদিনই
ক্যুরিয়ার করলাম। লেখাটা হাতে পাওয়ার পরে সমীরণদাকে উচ্ছ্বসিত দেখতে পেলাম। ফোন
করে প্রায় একঘন্টা কথা বললেন। আমার আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেল। এরপর তো ‘অমৃতলোক’-এর
একেকটা সংখ্যায় ৩-৪টি গদ্যও লিখেছি। প্রচুর ভারি-ভারি অনুবাদ করেছি।
‘অমৃতলোক’-এ
হাল্কা লেখার জায়গা ছিল কম। অনেক লেখক ওই কারনেও ক্ষুন্ন ও আহত হয়েছেন লেখা
পাঠিয়ে। অনেক নামী লেখক। লিটল ম্যাগাজিন যে সো কলড বানিজ্যিক পত্রিকার বাপ হতে
পারে, ‘অমৃতলোক’ দেখিয়ে দিয়েছে। লিটল ম্যাগ বানিজ্যিক পত্রিকার
বাইপ্রোডাক্ট নয়, বরং নেমেসিস। হয়ত এই কারনেই দেখতাম কেউ কেউ ‘অমৃতলোক’কে
লিটল ম্যাগ মনে করতেন না, কারন অত অর্থ ব্যয় করে, অতখানি মাপ নিয়ে দাপট নিয়ে
উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিয়ে একটি পত্রিকার প্রকাশ তাঁদের অস্বস্তি দিত, হীনমন্যতা দিত। একেকটা
সংখ্যা প্রকাশ করার জন্য সমীরণ-দা প্রভিডেন্ড ফান্ড ঋণ নিয়েছেন, সেই টাকা ফেরত
আসেনি। বাস্তবিক, ঘাম আর রক্ত দিয়েই কাগজ চালাতেন উনি।
আমার প্রতি
পক্ষপাতিত্বের সীমা ছিলনা। কিন্তু বকাবকিও খেয়েছি। উনি বকতেন, কারন অনেক সময় ওঁর
মনে হত আমি কোনো গদ্যকে রি-রাইট করিনা। আর আমার বিশ্বাস ছিল একটা গদ্য দ্বিতীয়বার
লিখলে সেটা অনেক ত্রুটিমুক্ত হয় বটে, কিন্তু তার প্রাণটায় টান পড়ে। তখন একটা
সিটিং-এ একটা গদ্য লিখতাম। আজ পারিনা। আজ একটা গদ্য লিখতে অনেক সময় একমাস লেগে
যায়। ঘসামাজা করি। আজ সমীরণদা জিতে গেছেন। আমার কবিতা সমর্থন করতেন বলে মনে হয়না।
আবার আমাকে দিয়েই ‘অমৃতলোক’-এর কবিতা বিভাগ সম্পাদনা করাতেন, আলাদা সম্পাদকীয়সহ।
হাতেখড়ি বলা যায়।
সম্পাদনার অনেক কিছুই ওঁর থেকে শেখা। চোখের সামনে গড়ে উঠতে
দেখেছি একের পর এক সংখ্যাকে। শেষ যে কয়েকটি সংখ্যা করেছিলেন, ‘চিন্ময় গুহ সংখ্যা’, ‘রবীন্দ্র
সংখ্যা’, ‘বিবেকানন্দ সংখ্যা’... সেগুলো বাংলা সাহিত্যের চিরসম্পদ। ‘সবুজপত্র সংখ্যা’-র
কাজ চলছিল। খবর পেয়েছি ওঁর মৃত্যুর সুযোগে কেউ সেই সংখ্যার প্রায় সম্পূর্ণ প্রুফ
চুরি করে নিয়েছে। খবর পেয়েছি ওঁর বইপত্তর এবং দুষ্প্রাপ্য কিছু সংগ্রহ চুরির
পরিকল্পনাও নাকি হয়েছিল, ওঁর মৃত্যুর সময়ে অনেকেই ভিড় করেছিলেন যাদের সমীরণ
মজুমদার পছন্দ করতেন না, ওঁর মৃত্যুতে তাঁদের কিছু সুবিধাই হবে, অশিক্ষার
আবহাওয়াটা আরো জাঁকিয়ে বসবে। সমীরণ অশিক্ষার শত্রু ছিলেন। সেই কারনেও অনেকের
অপছন্দের ও অস্বস্তির পাত্র ছিলেন। জীবনের শেষের দিনগুলো পুরোপুরি একাই কাটিয়ে
গেলেন। মদে ডুবে গিয়েছিলেন, সেটা সবাই দেখত, লোকটার বুকের চামড়া তুলে একটাও উঁকি
কেউ দিলেন না। একটা সামাজিক দায়বোধ থেকেই ওঁর দায়িত্ব নেওয়াটা ওঁর শহরের লিটল
ম্যাগ কর্মীদের উচিত ছিল। তাঁরা সেটা করলেন না।
অনেক সময় অনেক
সিদ্ধান্ত মানতে পারিনি। অমিতাভ সমাজপতির ‘ফিরোজা’-র
মতো উপন্যাস নিয়ে উনি ক্রোড়পত্র করলেন, একটি নড়বরে উপন্যাস, আমি মানতে পারিনি।
নন্দীগ্রামের সময়ে একের পর এক সরকার বিরোধী সংখ্যা করলেন। আমি মানতে পারিনি।
লিখেছিলাম। কিন্তু মনে হয়েছিল ‘অমৃতলোক’ সাহিত্যপত্রিকা হিসেবে নিজের ভূমিকা থেকে সরে যাবে
কেন! লোকনীতি তো তার কাজ নয়! প্রতিবাদ অবশ্যই হোক, কিন্তু একটা সংখ্যাতেই হোক। এসব
বললে সমীরণদা রেগে যেতেন। নিজের নীতি ও জীবনদর্শন ছাড়া আর কোনো উগ্রতা ওঁর মধ্যে
আমি দেখিনি। নিজের নিয়মে বাঁচতেন। মদ্যপান করলে ভেতরের সবটুকু আবেগ বাইরে বেরিয়ে
আসত, সেইসময় ওঁর মুখোমুখি হওয়া ঠিক ততটাই কঠিন হত যতটা সোজা ছিল ওঁকে ভুল বোঝা।
অনেকের সঙ্গেই সম্পর্ক রাখতে পারেননি মানুষটি তাই।
হ্যাঁ, সমীরণদাকে রাগানো ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে সোজা কাজ।
অত্যন্ত কোপন ছিলেন। আমার সঙ্গে কথা বন্ধ হয়েছে, আবার দ্বিগুণ টানে কথাও হয়েছে।
বাড়িতে নেমন্তন্ন করে খাইয়েছেন বহুবার। আমি যে মাছ পছন্দ করিনা, সেটা খেয়াল
রাখতেন। বন্যাপরিস্থিতি অতিক্রম করে আমার মেয়ের অন্নপ্রাশনে এসেছেন। ওঁর ভালোবাসা
যে অল্প কয়েকজন পেয়েছেন, আমি তাঁদের একজন। এটা আমার সৌভাগ্য মনে করি। আমিও খুব
অল্প মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে পেরেছি জীবনে। আমি যখন যেতাম আমাকে সঙ্গে নিয়ে
বাজারে যেতেন, নিজে টুকটাক রান্নাও করতেন রান্নার মহিলাটিকে সরিয়ে। ওঁর বাজারের
প্রশংসা করলে, রান্নার সুখ্যাতি করলে শিশুর মতো খুশি হতেন। পাতে কিছু ফেলে রেখে
উঠে যাওয়া চলত না।
আমার কোনো গুরু নেই। কিছু গুরুজন আছেন। তাঁদের একজন চলে
গেলেন। আমি একটু একা হয়ে গেলাম, আরো। আর এই সময়টা রিক্ত হয়ে গেল, কারন ‘অমৃতলোক’
আর নেই, সম্ভবত।
‘বাক্ ৯৩’
সমীরণ মজুমদারকেই উৎসর্গ করলাম। মেদিনীপুরের সেই রাগী অদ্ভুত বেমানান লোকটিকে।
চিয়ার্স সমীরণদা, আমি মদ খাওয়া চিরতরে ছেড়ে দিয়েছি, তবু... চিয়ার্স!!!!
অনুপম মুখোপাধ্যায়
(পরিচালক বাক্ )
(পরিচালক বাক্ )